:: জাকি ফারুকী :: লালমনিরহাট ১৯৬৫-৬৬ শান্ত ছোট্ট এক জনপদ। মানুষ হেঁটে চলে সব খানে। সর্বসাকুল্যে চার খানা রিকসা, ট্রেন এলে রিকসা স্ট্যান্ডে এসে যাত্রী খোঁজে।সাইকেল আরোহী কিছু মানুষ, টিংটিং করে বেল বাজিয়ে যায়। রেলের ওয়ার্কশপ আর কয়লার ডিপোতে সারাক্ষণ একটা ব্যস্ততা থাকতো।
কয়লা লোডিং, ইঞ্জিনের শব্দ, রেল ওয়াগন সান্টিং, ইঞ্জিন ঘোরানো, সিক লাইনে পানি দিয়ে ট্রেন ধোয়া, কিশোর বালক যদি স্কুল যেতে না চায়, এসব দেখেই দিন পার করে দিয়ে,
চারটার সময় বাসায় এলেই, গুড বয়।
মা জিজ্ঞাসা করবে?
তেমন সুযোগ দেয়া যেতো না। ক্ষুধার কথা বলতেই, ভাত, আলুভর্তা, ডাল, সিমভাজী।
অতি সাধারণ খাবার, কিন্তু এখনো মনে হলে, জিহ্বায় লালা ভরে আসে।
তখন ডিম, মাংস, মাছ মধ্যবিত্ত পরিবারে, খুব কমই দেখা মিলতো।
প্রতিটি সংসারে চার থেকে দশজন ভাইবোন। তাদের স্কুল, পড়াশোনার খরচ, পোষাক, বই কেনা, খাওয়ার সকল ব্যবস্থা, এখন ভাবি বাবা মায়েরা কেমন করে নির্বাহ করতেন। দু কামরার ছোট কোয়ার্টারে কেমন করে এতোজন ভাই-বোন, বাবা-মা, মাঝে মধ্যে আত্মীয়-স্বজনসহ জায়গা হতো!
লালমনিরহাট একটা গন্ডীবদ্ধ বিশাল সমাজ, যেখানে সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ কাজের জন্য আসছেন, দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছেন। আমার নানা মীর আজিজুল হক, প্রায় ২৮ বছর লালমনিরহাটে চাকরী করেছেন। তাঁর বারোজন সন্তান লালমনিরহাট অথবা বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেছে।
নানীর বাপজান তাঁর মেয়ের এক খেয়ালী জামাই এর সাথে টানাটানির সংসার দেখে, তেলীহারা থেকে জমি বেচে, সুলতানগঞ্জ পাড়া, নামাজগড়, বগুড়ায় প্রায় সাতবিঘা জায়গার ওপর, একটা মাটির বাড়ী বানিয়ে দেন।
আমার নানা ১৯৫২ সালে সংসার ত্যাগ করে, নিখোঁজ হয়ে গেলেন।
তাঁকে আর কখনো ফিরে পাওয়া যায়নি, বা তাঁর মৃত্যুরও কোন খবর পাওয়া যায়নি।
আমার নানী তাঁর উঁচু দেয়াল পরিবেষ্টিত গ্রামীণ পরিবেশের বাড়ীতে, সারা বছরের সমস্ত তরিতরকারী আবাদ করতেন, নানান মৌসুমী ফলের টানে নানীর বাড়ীতে যাবার আমাদের এক ধরনের মোহ সব সময় জেগে থাকতো।
আমরা যখন নানীবাড়ী যেতাম, তখন উৎসব মনে হতো সারা বাড়ীটায়।
এতো মানুষ, অথচ কি আশ্চর্য নীরবতার মাঝে, খাওয়া-দাওয়া সমাপ্ত করে, মাটিতে বিছানা করে শ্রেণীমতো সবাই ঘুম, পরবর্তী সকালে ওঠা, নাস্তা চা দুধ বিস্কিট মুড়ি, কোন কিছুর কমতি নেই। এখন আমাদের ছোট্ট সংসারে, একজন বন্ধুকে রেখে কদিন আত্মীয়তা করবো, এমন ভাবতে পারি না। অথচ সেই দিন, হাতের নাগালের মধ্যে, মনে হয় মুঠো করে ধরে নিয়ে আসি, সবাই মিলে হাসি আনন্দ করি।
একদিন আমার ছোট মামা, এক মাদ্রাসার নুতন খোঁড়া একটা পুকুরে গিয়ে, সব বন্ধুদের নিয়ে দিনমান সাঁতার কাটলেন। আমি তখন স্কুলে যাই না।
সাঁতার শেখার বিশেষ আগ্রহ থাকায়, দু একবার পানিতে নেমে, পুকুরের গভীরতা বেশী হওয়ায় পাড়ে উঠে এলাম।
বাড়ীতে ফিরতেই নানী একটা বাঁশের কাবারি দিয়ে দুটো এমন বাড়ি দিলেন, আমার হাতের পিছনে বেশ খানিকটা ছিলে গেলো।
নানী আমার শরীরে রক্তপাত ঘটিয়ে, একটু নমনীয় হলেন, অনেক কিছু খেতে দিলেন, কিন্তু সাঁতার শেখার জন্য আর যেনো না যাই তার প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন।
নানীর বড় নাতী হিসেবে সব সময় অনেক ফেভার পেলেও, শাসনের সময় তাঁকে নিজের মতো করে কাজ করতে দেখেছি।
সংসারে তখন শাসন মানে, বেতের বারি। আজকাল যা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। হিসেব করে দেখা উচিত মাইর আবার ফিরিয়ে আনা যায় কি-না। সেই পুকুরে সাঁতার শেখা কচি মামা/ মীর মোনাজ হক, ১৯৭৪ এর পর থেকে বার্লিন প্রবাসী, মুক্তিযুদ্ধে বাহাদুরাবাদ এ রেলওয়ে ফেরীর চলাচল বন্ধে “লিমপেট মাইন” দিয়ে ফেরী ডুবিয়ে, পাকিদের ভালোই নাকানি চুবানী খাইয়েছেন। মামার বন্ধুদের সাথে পার্কে ঘোরা, দিনমান না খেয়ে শহরে চক্কর দেয়া, এই অভ্যাসটা ভালই রপ্ত করেছিলাম। পথে পথে ঘুরে বেড়ানো, নুতন বাড়ী, বড় গাছ, উঁচু দালান, বড় পুকুর, শীর্ণা নদী, কাশবন, এসবের মাঝে জীবনের আনন্দ খুঁজে পেতাম।
শহর থেকে বেরিয়ে গ্রাম দেখা, চাষাবাদ দেখা, মাছধরা দেখা, এসব সময় পেলেই করতাম।
আমার দাদা কৃষক ছিলেন। শহরে আমাদের বাসায় আসলে দাদাকে আমার মা’কে অনেক আদর যত্ন করতে দেখতাম। দাদাকে নামাজে দেখতাম, নামাজের ওয়াক্তে।
নামাজে কাঁদতে দেখতাম মোনাজাতের সময়, উনি ইচ্ছা করতেন, যেনো হজ্বে যেতে পারেন, আর হজ্বের পর উনি যেনো ফিরে না আসেন।
১৯৭৪ সালের শেষ দিকে, সে দিন আমার মেডিকেল কলেজে ভর্তির রেজাল্ট হয়েছে। বাসার সামনে দুষ্টমি করছিলাম, এমন সময় আমার আব্বার মামাতো ভাই কাদের চাচা আসলেন, আমাদের জানালেন, আমার দাদা, ফিরে আসবার দিন সকালে ইন্তেকাল করেছেন, এবং তাঁকে জান্নাতুল বাকীতে কবরস্থ করা হয়েছে।
আমার দাদার জেনারেশনের সেই চলে যাওয়া শুরু।
আমার মনে হতো, কৃষি প্রধান পারিবারিক আমাদের সেই ঐতিহ্য দাদার পর শেষ হয়ে যাবে।
তাই হয়েছিলো।
ভোরে শয্যা ত্যাগ করে, তৈরী হয়ে, ঘাড়ে লাঙ্গল জোয়াল নিয়ে, দাদাকে দেখতাম জমির উদ্দেশ্যে বের হতেন, সামনে চাষের গরু দুটো।
সূর্যের তেজ বারবার আগেই জমিচাষের কাজ শেষ করে এসে, গোসল সেরে, পান্তা ভাতের সাথে সুটকি ভর্তা, মসুর ডালের পানি, বেগুন ভাজা, সব কিছুই নিজের জমিনের।
আমার বড় চাচার একটা সরিষা মাড়াই করার কাঠের তৈরী মাড়াই এর ঘর ছিলো।
অবসর সময়, মাড়াই ঘরে যেয়ে, গরুর পিছনে বসে, থাকতাম চওড়া কাঠের ওপর। গন্ধ নিতাম সরিষা মারাই করার পর টুপটুপ করে ঝরে পরা ঈষদুষ্ণ সরিষার তেলের। সেই সরিষার মাড়াই গছ, এখন আর কোথায় আছে? কিছু মানুষ পৈতৃক ব্যবসা মনে করে, নিদারুন দারিদ্রকে সহযাত্রী করে, খাঁটি সরিষার তেল ব্রান্ডিং করে ব্যবসা চালানোর চিন্তা করে, কিন্তু তার দিন শেষ হবে। এখন জহুরউল্যা মন্ডলের চতুর্থ পঞ্চম প্রজন্ম ষাট থেকে পঁয়ষট্টি মাইল স্পীডে,
আট লেনের হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলে, চারপাশে দৌড়ে যাচ্ছে নানান ব্রান্ডের গাড়ী, আর ত্রিশ মাইল দুর নিউইয়র্ক।
এলিজাবেথ এর চারপাশে, রিফাইনারীর একটা প্রকট গন্ধ, মানুষ এটাই স্বাভাবিক মনে করে।
গন্ধ বদলে গেছে মানুষ, বদলে গেছে জীবন। এরপর আর সেই সব দিনের কথা কে মনে করবে?
পেনসিলভেনিয়ার অ্যামিষদের দেখতে যায় অনেকে। তাঁরা আর কতটুকু পারবে একশ বছর আগের আমেরিকাকে ধরে রাখতে।
এভাবে একদিন বিস্মরনের পালা শেষ হবে।
তখন, বন্ধ জানালার এধারে জহুরউল্যা মন্ডলের পন্চম প্রজন্ম ইয়েন রেজওয়ান পাখিদের দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছে, ওরা ঘাসের মধ্যে পোকা খুঁজছে, এতো খাবার এতো কিছু সবখানে, পাখিদের জন্য কিছু নেই।
৮/৫/২৪, নিউজার্সি